আপনি কি জানেন ?
বর্তমান বিশ্বের বড় বড় যুদ্ধ সাইকোলজিক্যাল ওয়ার এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। আর এই যুদ্ধ আমাদের মস্তিষ্ক এবং অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা যখন একে অপরের সাথে শারীরিক লড়াই করি, তখন আমাদের মন, যা আসলে আমাদের সিদ্ধান্ত এবং অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করে, তা নির্বিকার থাকে। কিন্তু যদি কেউ আমাদের মস্তিষ্কের দখল নেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমরা সেই লড়াইয়ে পরাজিত হই, যদিও আমরা নিজেদের শারীরিকভাবে স্বাধীন মনে করি।
তাই আজকের এই আর্টিকে মাধ্যমে জানব, কিভাবে সাইকোলজিক্যাল ওয়ার আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে এবং ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী মনের স্বাধীনতা অর্জনের উপায়।
সাইকোলজিক্যাল ওয়ার এবং আমাদের দাসত্ব
বিশ্বের বহু শক্তি সাইকোলজিক্যাল ওয়ার ব্যবহার করে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে। উদাহরণস্বরূপ, কোকার কোলা বা পেপসি যেমন ইসরায়েলকে সাহায্য করে, তেমনই এই কোম্পানিগুলোর পণ্য আমরা অজান্তেই নিজেদের জীবনযাত্রার অংশ বানিয়ে ফেলি। যে শক্তি আমাদের মস্তিষ্কে কাজ করে, তা আমাদের আবেগ, অভ্যাস, এবং সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে।
ব্রেনের দুইটি স্তর আছে—কনসিয়াস মাইন্ড এবং আনকনসিয়াস মাইন্ড। আমাদের অবচেতন মনেই এ সব আবেগ, অভ্যাস এবং চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এবং এটি চারটি সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়:
- খুশির সময়
- দুঃখের সময়
- খাবারের সময়
- ঘুমের সময়
এই সময়গুলিতে আমাদের মস্তিষ্ক খোলামেলা থাকে এবং যে কিছু প্রবেশ করে, তা সহজেই অভ্যাসে পরিণত হয়। একেই বলা হয় ‘অবচেতন মনের দাসত্ব’। এই একই মেকানিজমে কোকা-কোলা বা পেপসির বিজ্ঞাপনও আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। খেলার মাঠে, বিশেষত যখন আমরা কোনো দল জিতি বা হারি, তখন সেই অনুভূতি আমাদের অবচেতন মনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং আমরা জানতেও পারি না কিভাবে এসব অভ্যাস তৈরি হয়।
সাইকোলজিক্যাল ওয়ার ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে মনের স্বাধীনতার পথ।
ইসলাম আমাদের শেখায় যে, আমাদের মনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা আমাদের দায়িত্ব। মনের শক্তি এবং ঈমানের শক্তি আমাদের প্রতিটি চিন্তাভাবনা এবং কাজের পথনির্দেশক হওয়া উচিত। আল্লাহর যিকির, সৎ কাজের প্রচেষ্টা, এবং দ্বীনী শিক্ষা আমাদের মস্তিষ্কে সঠিক চিন্তা ও অনুভূতি গড়ে তোলার পথ দেখায়।
এছাড়া, ইসলামে অভ্যাস পরিবর্তন এবং আত্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে অনেক দিকনির্দেশনা রয়েছে। রাসুল (সা.) এর শিক্ষা এবং সাহাবাদের মনোভাব আমাদের প্রেরণা দেয় কিভাবে সঠিকভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের দিকে মনোযোগ দিন এবং সৎ কাজের মাধ্যমে দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সায়েন্স থেকে উপায়
মনোবিজ্ঞানের গবেষণা অনুযায়ী, অবচেতন মনের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের অভ্যাস, চিন্তা এবং অনুভূতির উপর সচেতনভাবে কাজ করতে হবে। সচেতন মন এবং অবচেতন মনকে সমন্বিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সঠিক পদ্ধতিতে ধ্যান, সঠিক চিন্তা এবং অনুশীলন প্রয়োজন। একে “কগনিটিভ রিহ্যাবিলিটেশন” বলা হয়, যেখানে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণকে পরির্বতিত করার কাজ করা হয়।
মনের স্বাধীনতা
বিশ্বে শারীরিকভাবে স্বাধীন হওয়ার পরেও, আমাদের মনের স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় সংগ্রাম। সাইকোলজিক্যাল ওয়ার আমাদের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের প্রতিফলন। ইসলামের দৃষ্টিকোণ, সচেতন মন এবং আধুনিক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, আমাদের মস্তিষ্কে নিয়ন্ত্রণ রেখে, আমরা একে মুক্ত করতে পারি। এজন্য আমাদের প্রাথমিকভাবে নিজেদের চিন্তা, অভ্যাস, এবং অনুভূতির প্রতি সচেতন হতে হবে, যাতে আমরা এই অদৃশ্য যুদ্ধের মধ্যে জয়ী হতে পারি।
বিশ্বব্যাপী সাইকোলজিক্যাল ওয়ারের প্রভাব
আজকের দুনিয়া, যা প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানে ভরপুর, সে পৃথিবীতে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বজুড়ে কিছু বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং শক্তি, আমাদের মস্তিষ্কে একটি নির্দিষ্ট ভাবনা বা বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়, যা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক দাসত্ব সৃষ্টি করে। বিজ্ঞাপন, সোশ্যাল মিডিয়া, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন—সবই আমাদের মানসিকতা এবং অভ্যাসের ওপর এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রা, পণ্য নির্বাচন, এমনকি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও প্রভাবিত হয়। আমরা এমন কিছু পণ্য বা বিশ্বাস গ্রহণ করি, যা আমাদের নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলে, কিন্তু আমাদের মস্তিষ্ক এদের সম্পর্কে চিন্তা করেও অজান্তেই গ্রহণ করে ফেলে।
এটা সেই সময়ের কথা, যখন মানুষের মানসিক শক্তি তথা মস্তিষ্কের দখলই ছিল সকল যুদ্ধের মূল লক্ষ্য। আজকাল প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞাপন শিল্প এ কাজটিকে আরও শক্তিশালী করেছে।
ইসলামের নির্দেশনা: মনের শক্তি ও সঠিক পথের অনুসরণ
ইসলাম একমাত্র ধর্ম, যা মানুষের মনের শক্তিকে অগ্রাধিকার দেয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আমাদের মনের প্রতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে আমরা মনের পবিত্রতা এবং একাগ্রতা অর্জন করতে পারি। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, “সত্যি যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের মনের ভেতরে সকল কথা জানেন।” (আল-মুজাদিলা 58:12)। এই আয়াতটি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহ আমাদের চিন্তা, অনুভূতি এবং সিদ্ধান্তগুলো জানেন। সুতরাং, আমাদের উচিত আমাদের মনকে সৎ, বিশুদ্ধ এবং ইতিবাচক চিন্তায় পূর্ণ রাখা, যাতে এটি কোনো মিথ্যা বা ভুল ধারণায় আবদ্ধ না হয়।
রাসুল (সা.) বলেছেন, “একটি চিরস্থায়ী সৎ কাজ ও বিশুদ্ধ মন মানেই একজন মুসলিমের সফলতা।” এখানে রাসুল (সা.) আমাদের শেখাচ্ছেন যে, সৎ মনোভাব এবং আত্মবিশ্বাস আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলে এবং সফলতার দিকে পরিচালিত করে। তাই, আমরা যতটা সম্ভব আমাদের মনকে খারাপ চিন্তা এবং দাসত্ব থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
সায়েন্স ও মনের দাসত্ব: কেন আমরা দাসত্বের শিকলে আবদ্ধ হই?
মনোবিজ্ঞানের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, মানুষের মস্তিষ্ক প্রথম থেকেই অভ্যাস তৈরির দিকে কাজ করে। আমাদের অবচেতন মন প্রতিনিয়ত নতুন অভ্যাস, বিশ্বাস এবং আচরণের বীজ বপন করে। একে সাইকোলজিক্যাল কন্ডিশনিং বলা হয়। মানুষের মস্তিষ্ক বিভিন্ন রকমের তথ্য, অনুভূতি এবং অভ্যাস সংগ্রহ করে যা পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। যেমন, কোনো কিছু ঘটলে আমরা আবেগি, সঙ্কটময় অবস্থায় ভেঙে পড়ি বা কিছুটা সুখী হয়ে উঠি। এই পরিবর্তনগুলো সচেতনভাবেই আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে এবং অবচেতনভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। এই প্রক্রিয়া এতটাই সূক্ষ্ম যে, আমাদের পক্ষে এটি ধরতে বা প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
আজকালকার যুগে, অনেক ব্র্যান্ড, মিডিয়া হাউজ এবং বড় প্রতিষ্ঠান তাদের বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা দিয়ে আমাদের অবচেতন মনকে প্রভাবিত করে। এই প্রক্রিয়া এমনভাবে কাজ করে, যে আমরা বুঝতেই পারি না যে, এই বিজ্ঞাপন বা পণ্য আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে কীভাবে প্রভাবিত করছে। আমাদের মস্তিষ্কে নানা ধরনের দৃশ্য, শব্দ এবং অনুভূতি ঢুকে যায় যা পরে আমাদের জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়।
মনের স্বাধীনতা: পরিবর্তনের চাবিকাঠি
এই সাইকোলজিক্যাল প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য, প্রথমেই আমাদের মনের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এক্ষেত্রে, সঠিক দৃষ্টিকোণ এবং ইসলামী শিক্ষা আমাদের পথ প্রদর্শক হতে পারে। ইসলাম আমাদের শেখায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তার জীবনকে ইসলামী আচার-আচরণে পরিচালিত করে, সে কখনই অবচেতন মনের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। বরং সে নিজের মস্তিষ্কে সঠিক চিন্তা, ইতিবাচক অভ্যাস এবং সর্বোপরি ঈমানের শক্তি দ্বারা নিজের জীবন পরিচালিত করবে।
সায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকেও বলা যায়, যে ব্যক্তি সচেতনভাবে নিজের চিন্তাভাবনা এবং অভ্যাসে পরিবর্তন আনে, সে মানসিক স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ধারণা দেন, যে ব্যক্তি নিজের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম, সে তার জীবনে অধিক সুখ এবং সফলতা অনুভব করবে।
উপসংহার: মনের শক্তি এবং সঠিক পথ অনুসরণ
সাইকোলজিক্যাল ওয়ার, আধুনিক বিজ্ঞানের অবাধ প্রবাহ এবং ইসলামী শিক্ষা—এই তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের মনের শক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই শক্তি, যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, তবে তা আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে বিপুল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ইসলামের দৃষ্টিতে, আমাদের মনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং সত্য পথে অবিচল থাকা একমাত্র পথ যা আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে। আর সায়েন্স বলছে, সচেতন মন এবং অবচেতন মনকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করলেই আমরা সাইক্রোলজিক্যাল ওয়ারের বিরুদ্ধে সফল হতে পারব।
আমাদের উচিত নিজেদের মনে সৎ চিন্তা ও শক্তিশালী ঈমানের শক্তি প্রতিষ্ঠা করা, যাতে আমরা বিশ্বব্যাপী মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে পারি।
লেখক, আব্দুল্লাহ আল নোমান
অধ্যায়নরত, উচ্চতর আরবি ভাষা ও সাহিত্য জামিয়াতুল উস্তায শহিদুল্লাহ ফজলুল বারি , মোহাম্মদপুর, ঢাকা