এক সময়ের কথা, আরবের এক সমৃদ্ধ নগরে আব্দুল্লাহ নামে এক প্রভাবশালী বণিক বাস করতেন। তিনি ব্যবসায়িক সফলতার জন্য খ্যাত ছিলেন এবং নগরের ধনীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তার ধন-সম্পদ ছিল অপরিসীম—অগণিত সোনা-রূপার মুদ্রা, জমিদারি, ব্যবসায়িক জাহাজ, এবং অসংখ্য চাকর-চাকরানী। তার বিশাল বাড়ি ছিল বিভিন্ন মূল্যবান রত্নে সজ্জিত এবং তার বাগানগুলো ছিল দুষ্প্রাপ্য ফুল আর ফলের গাছে ভরা। আব্দুল্লাহর শৌখিন জীবনযাত্রা ছিল সবার চোখে ঈর্ষণীয়, নগরের মানুষ তার নাম সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করত।
অশান্তির কারণ
তবে, আব্দুল্লাহর মনে কিছু একটা অজানা শূন্যতা কাজ করত। এত ধন-সম্পদ থাকার পরেও তিনি এক অদ্ভুত অস্থিরতায় ভুগছিলেন। প্রতিদিন নতুন নতুন ব্যবসা বিস্তারের চিন্তায় ডুবে থাকলেও তার অন্তরের শান্তি যেন কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল। মনে হতো, তিনি এক মহাসমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ তৃষ্ণা মেটাতে এক ফোঁটা পানিও পান করছেন না। তিনি বুঝতে পারছিলেন না, এই সম্পদের মাঝে কেন তার মন এত অসন্তুষ্ট?
মরুভূমির পথে
একদিন, আব্দুল্লাহ সিদ্ধান্ত নিলেন তার কিছু ব্যবসায়িক কাজের জন্য নগর ছেড়ে মরুভূমির পথে রওনা দেওয়ার। এই সফরটি তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ এর মাধ্যমে তিনি নতুন বাণিজ্যিক চুক্তি করতে পারতেন এবং তার সম্পদের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করতে পারতেন। কিন্তু পথ চলতে চলতে তার মন যেন অন্য কিছুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনি ভাবছিলেন, জীবনের প্রকৃত মূল্য এবং সুখ কী, এবং কেন তিনি এত অস্থির?
এক দরিদ্র মানুষের শিক্ষা ।ইসলামিক গল্প
অবশেষে, ক্লান্ত হয়ে তিনি একটি বড় গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বসলেন। চারপাশে দূরদূরান্তে ধু ধু করছে বালুরাশির বিস্তৃতি। সেই নির্জনতার মধ্যে, হঠাৎ তার চোখে পড়ল দূরে এক দরিদ্র মানুষের অবয়ব। মানুষটি ফকিরের মতো সাধারণ পোশাক পরা, গায়ে জীর্ণ কাপড়। তবে তার চেহারায় এক অদ্ভুত শান্তির ছাপ ছিল। তিনি একটি বড় পাথরের ওপর বসে আছেন, দু’হাত আকাশের দিকে তুলে আল্লাহর প্রশংসা করছেন। মুখে তার যেন কোনো কষ্টের চিহ্ন নেই, বরং এক প্রশান্তি মাখানো হাসি ফুটে আছে।
আধ্যাত্মিক উপলব্ধি
আব্দুল্লাহ বিস্মিত হলেন। একজন দরিদ্র, যার কাছে কোন সম্পদ নেই, যার জীবন হয়তো অনিশ্চয়তায় ভরা—সে কীভাবে এত সুখী ও প্রশান্ত থাকতে পারে? আব্দুল্লাহ সেই দরিদ্র মানুষটির কাছে গিয়ে বললেন, “হে দরিদ্র, তোমার তো কিছুই নেই। তুমি কেমন করে এত শান্তি এবং সুখে আছো?”দরিদ্র মানুষটি হেসে বলল, “হে প্রিয় ভ্রাতা, আমি দরিদ্র নই। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা আমার জন্য যথেষ্ট। আমি আল্লাহর অনুগ্রহে সন্তুষ্ট। তিনি আমাকে যা দিয়েছেন, তা দিয়েই আমি খুশি। তিনি যা দেননি, তার জন্য আমি কখনো মন খারাপ করি না। কারণ আল্লাহ যা করেন, তা আমাদের কল্যাণের জন্যই করেন। তাই আমি তার ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে জীবন কাটাই।”আব্দুল্লাহর হৃদয়ে এই কথাগুলো গভীরভাবে আঘাত করল। এত সম্পদ, এত ক্ষমতা, এত প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি শান্তি পাচ্ছেন না? কেন তার হৃদয় এভাবে অস্থির? কেন জীবনের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও তার কাছে কিছুই অর্থবহ মনে হচ্ছে না?
নতুন লক্ষ্য
আব্দুল্লাহ সেই দরিদ্র মানুষটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলেন। কিন্তু তার মন থেকে দরিদ্রের সেই কথাগুলো কিছুতেই মুছে যাচ্ছিল না। তিনি ভাবলেন, “কেন আমি এত অস্থির? কেন আমার এত কিছু থাকার পরও আমি তৃপ্ত নই?” বাড়ি ফিরে এসে তিনি তার প্রাসাদের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকলেন।দিনের পর দিন তিনি সেই দরিদ্র মানুষের কথা ভাবতে লাগলেন। তিনি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলেন, সম্পদের পেছনে ছুটে জীবন কাটানোর চেয়ে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে সন্তুষ্ট জীবন যাপন করাই প্রকৃত শান্তির উৎস। ধনসম্পদ জীবনকে আরাম দিতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের শান্তি দেয় না।
মানুষের সেবা
একদিন, আব্দুল্লাহ নিজের জীবনের নতুন লক্ষ্য স্থির করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তার জীবনের বাকি সময় তিনি আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী চলবেন এবং মানুষের সেবায় নিজেকে নিবেদিত করবেন। তিনি তার প্রচুর ধনসম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিলেন।অনেক মসজিদ নির্মাণ করলেন, যেখানে মানুষ এসে নামাজ আদায় করতে পারত এবং আল্লাহর ইবাদত করতে পারত। এতিমদের জন্য আশ্রয়স্থল তৈরি করলেন, যেখানে তারা সুরক্ষা ও শিক্ষার সুযোগ পেত। রোগীদের চিকিৎসা সেবার জন্য হাসপাতাল স্থাপন করলেন, যাতে দরিদ্র মানুষজন বিনামূল্যে চিকিৎসা পেতে পারে।
আন্তরিক শান্তি
মানুষের মাঝে তার দানশীলতা এবং সহানুভূতির কথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। নগরের লোকজন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। কিন্তু আব্দুল্লাহর কাছে এসব বাহ্যিক প্রশংসা কোনো গুরুত্ব বহন করত না। তার হৃদয়ের শান্তি এখন আল্লাহর প্রতি আস্থা এবং মানুষের সেবায় ছিল।আস্তে আস্তে আব্দুল্লাহর মনের সব অস্থিরতা দূর হয়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, জীবনের সত্যিকারের সুখ এবং শান্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করা, তার দেয়া রিজিকে সন্তুষ্ট থাকা, আর মানুষের উপকারে নিজেকে নিবেদিত করার মধ্যেই রয়েছে।
উপসংহার
আমরা এই ইসলামিক গল্প থেকে শিক্ষা পেলাম যে, ধন-সম্পদ হয়তো বাহ্যিক আরাম দিতে পারে, কিন্তু তা কখনো মনের অস্থিরতা দূর করতে পারে না। আল্লাহর অনুগ্রহে এবং তার দেখানো পথে চলার মধ্যেই মানুষের জীবনের আসল অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।এভাবেই আব্দুল্লাহ একজন প্রভাবশালী বণিক থেকে একজন প্রকৃত ধার্মিক ও আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত মানুষেরূপে নিজেকে গড়ে তুললেন। তার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে গেছেন, এবং এই কাজের মধ্যেই তিনি পেলেন সেই শান্তি, যা তিনি এতদিন সম্পদের মধ্যে খুঁজে পাননি।